নেই, থাকে না

সূর্যকে ছোঁয়ার জন্যে একা চাঁদ ঘোরে চক্রাকারে
ঘুরতে ঘুরতে চাঁদ অভিমানে অমাবস্যা হয়।
চাঁদের আবেগে টান লাগে জলাশয়ে
জলের ফেনায় ফণা তোলে নদী; সূর্য নামে তাতে।
এমন নদীর তীরে কারো হাত ছিলো এই হাতে,
এনে পড়ে প্রায় প্রতিরাতে।
এখনও আগের মতো চাঁদ আছে, সূর্য আছে, আর
নদী আছে নদীর জায়গায়।
দিনেরাতে কল্লোলিত জ্যোৎস্নারৌদ্রে জ্বলে পটভূমি
শুধু নেই আমি আর তুমি।

তোমার জন্য কবিতা

তোমার আকাশ থেকে আমার জন্য
কেবলই লাবণ্য ঝরে না
মেঘ জমে শিশিরের ঘাম হয়ে
শিলা ও পাথর জমে মেঘে
বিষ্টির নাম করে ।

হাওয়ার চাদর উড়িয়ে তোমার অস্তিত্ব নামে
নেমে আসে
আমার পাতা ও কাণ্ডের ওপর
পাখির পালক হয়ে স্নিগ্ধতা গড়িয়ে পড়ে
কোনো কিছু স্নেহ নয় প্রিয়তা নয়
পাথর গড়িয়ে পড়ে গলে যায় ।

তোমার আকাশ থেকে আমার ওপরে
কোনোই লাবণ্য ঝরে না
তবু
টিকে থাকি বেঁচে থাকি
বিষ্টির লবণ একদিন লাবণ্য জমাবে
আমাদের জীবন শিকড়ে ।

সাহস থেকে প্রেম

আমার শুধু ইচ্ছে করে
সঙ্গে বসে থাকি ।
হঠাৎ করে তোমার গায়ে
গোপনে হাত রাখি ।

রাখতে রাখতে সাহস হবে
সাহস থেকে প্রেম,
বুঝবে আমি শিকড়গুলো
কিভাবে ছড়ালেম ।

আমার শুধু ইচ্ছে করে
সঙ্গে ভেসে যেতে,
ভাসতে ভাসতে সবটা নদী
বুকের কাছে পেতে ।

এমনি করেই সাহস হবে
সাহস থেকে প্রেম,
তখন তুমি বুঝবে না যে
কিভাবে জড়ালেম ।

আবার যখনই দেখা হবে

আবার যখনই দেখা হবে, আমি প্রথম সুযোগেই
বলে দেব স্ট্রেটকাটঃ ‘ভালোবাসি’।
এরকম সত্য-ভাষণে যদি কেঁপে ওঠে,
অথবা ঠোঁটের কাছে উচ্চারিত শব্দ থেমে যায়,
আমি নখাগ্রে দেখাবো প্রেম, ভালোবাসা, বক্ষ চিরে
তোমার প্রতিমা। দেয়ালে টাঙ্গানো কোন প্রথাসিদ্ধ
দেবীচিত্র নয়, রক্তের ফ্রেমে বাঁধা হৃদয়ের কাচে
দেখবে নিজের মুখে ভালোবাসা ছায়া ফেলিয়াছে।
এরকম উন্মোচনে যদি তুমি আনুরাগে মুর্ছা যেতে চাও
মূর্ছা যাবে,জাগাবো না,নিজের শরীর দিয়ে কফিন বানাবো।
‘ভালোবাসি’ বলে দেব স্ট্রেটকাট, আবার যখনই দেখা হবে।

আরো একজন

যেখানেই যাও তুমি, যেখানেই যাও
সঙ্গে যায় আরো একজন;
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ।

যেখানেই দৃষ্টি দাও, যেখানেই দাও
দৃষ্টি দেয় আরো একজন;
যদিও সুনীল তবু সেখানেই মেঘের গড়ন।

যাকেই যে কথা বলো, যাকেই যে কথা
শুনে যায় আরো একজন;
যদিও নিশ্চুপ তবু অবিরাম পদ্মার ভাঙন।

যেখানেই রাখো হাত, যেখানেই রাখো
রাখে হাত আরো একজন;
যদিও নিশ্চল তবু দ্রুত তার শিরায় স্পন্দন।

যখন শয্যায় তুমি, যখন শয্যায়
পাশে আছে আরো একজন;
যদিও ঘনিষ্ঠ তবু ঘুম কেড়ে নিয়েছে কখন।

তুমি কি দেখেছো তাকে ? চেনো তাকে ?
সচকিত মাঝে মাঝে তাই ?
তোমার সম্মুখে তবে আমি এসে আবার দাঁড়াই ?

আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে

আমার ভিতরে বাহিরে অন্তরে অন্তরে ,
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।

ঢেকে রাখে যেমন কুসুম, পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম।
তেমনি তোমার নিবিঢ় চলা, মরমের মূল পথ ধরে।

পুষে রাখে যেমন কুসুম, খোলসের আবরণে মুক্তোর ঘুম।
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া, ভিতরের নীল বন্দরে।

ভাল আছি ভাল থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।
দিয়ো তোমার মালাখানি, বাউলের এই মনটারে।
আমার ভিতরে বাহিরে…

বনলতা সেন

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন ।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

মায়াবন বিহারিণী

মায়াবন-বিহারিণী হরিণী,
গহন স্বপন সঞ্চারিণী,
কেন তারে ধরিবারে করি পণ, অকারণ।

থাক থাক নিজ মনে দূরেতে,
আমি শুধু বাঁশরীর সুরেতে
পরশ করিব ওর প্রাণমন, অকারণ।

চমকিবে ফাগুনের পবনে,
পশিবে আকাশবাণী শ্রবণে|
চিত্ত আকুল হবে অনুক্ষন, অকারণ।

দূর হতে আমি তারে সাধিব,
গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব,
বাঁধনবিহীন সেই যে বাঁধন, অকারণ॥

এক জীবনের সব হাহাকার

এক জীবনের সব হাহাকার
বুকে নিয়ে
অভিশাপ তোমাকে দিলাম,
তুমি সুখী হবে, খুব সুখী হবে।
বেদনা আমাকে নিয়ে আশৈশব
খেলেছে তুমুল আর
তিলে তিলে শিখিয়েছে সহনশী
নিলাজ নখের মত দুঃখ
কেটে কেটে আমি
আজকাল অর্জন করেছি ঠিক
উদ্ভিদের অদ্ভুত
মৌনতা,
ওলো উল্লাসিনী
না জেনে শুনে কেনো দিতে গে
তুমি আর কী বেদনা দেবে,
কতোটা নাড়াবে?
বালখিল্য এই খেলায় আমার
চেয়েও
বেশী তুমিই হারাবে।
এক জীবনের সব হাহাকার
বুকে নিয়ে
অভিশাপ তোমাকে দিলাম,
তুমি সুখী হবে,
ব্রহ্মপুত্রের মেয়ে, দেখে নিও, খুব
সুখী হবে।

তুলনামূলক হাত

তুমি যেখানেই স্পর্শ রাখো সেখানেই আমার শরীর৷
তোমার চুলের ধোয়া জল তুমি যেখানেই
খোঁপা ভেঙ্গে বিলাও মাটিকে;
আমি এসে পাতি হাত, জলভারে নতদেহ আর
চোখের সামগ্রী নিয়ে ফিরি ঘরে, অথবা ফিরি না ঘরে,
তোমার চতুর্দিকে শূন্যতাকে ভরে থেকে যাই৷

তুমি যেখানেই হাত রাখো, যেখানেই কান থেকে
খুলে রাখো দুল, কন্ঠ থেকে খুলে রাখো হার,
সেখানেই শরীর আমার হয়ে ওঠে রক্তজবা ফুল৷

তুমি যেখানেই ঠোঁট রাখো সেখানেই আমার চুম্বন
তোমার শরীর থেকে প্রবল অযত্নে ঝরে যায়৷
আমি পোকা হয়ে পিচুটির মতো
তোমার ঐ চোখের ছায়ায় প্রতিদিন খেলা করে যাই,
ভালোবেসে নিজেকে কাঁদাই৷

তুমি শাড়ির আঁচল দিয়ে আমাকে তাড়িয়ে দিলে
আমি রথ রেখে পথে এসে তোমারই দ্বৈরথে বসে থাকি
তোমার আশায়৷ তুমি যেখানেই হাত রাখো
আমার উদগ্রীব চিত্র থাকে সেখানেই৷ আমি যেখানেই
হাত পাতি সেখানেই অসীম শূন্যতা, তুমি নেই৷